আজকে, অর্থাৎ ২২শে জুলাই, ২০২৫ তারিখে, যখন এই সংবাদ লেখা হচ্ছে, গতকাল ২১শে জুলাই, ২০২৫ তারিখে সংঘটিত এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার খবর নিয়ে গোটা বাংলাদেশ জুড়েই গভীর শোক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় আমাদের বহু নিরপরাধ নাগরিক, বিশেষত কোমলমতি শিশুরা, শাহাদাত বরণ করেছেন। উত্তরায় সংঘটিত এই দুর্ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা যে দৃঢ়তা ও ন্যায্যতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তাদের যৌক্তিক ছয় দফা দাবি আজ সরকার কর্তৃক মেনে নেওয়া হয়েছে, যা খানিকটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
গতকাল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ী এলাকায় এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা, নিমেষেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। চোখের পলকে সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বিমানটির পাইলট, আমাদেরই ভাই, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর শাহাদাত বরণ করেন। হৃদয় বিদীর্ণকারী সংবাদ হলো, এই দুর্ঘটনায় ১৭ জন কোমলমতি শিশুসহ মোট ৩১ জন ইন্তেকাল করেছেন। আরো বেশী ইন্তেকাল হতে পারে, কিন্তু প্রশাসন থেকে সর্বশেষ এটাই জানা গেছে। এছাড়া ১৬৫ জন মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই এখন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। প্রাথমিক তদন্তে এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যান্ত্রিক ত্রুটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই ভয়াবহতার পরপরই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে নেমে আসে। তাদের চোখে ছিল পানি, কিন্তু কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা। তারা ছয় দফা সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরেছিল, যা আমাদের জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই দাবিগুলো ছিল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত এবং জনগনের প্রাণের কথা:
১. নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ: শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি ছিল নিহতদের সঠিক ও
পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করা।
২. আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ:
আহতদের বিষয়েও একই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
৩. শিক্ষকদের গায়ে হাত
তোলার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা: জনগণের ভিড় নিয়ন্ত্রণের নামে কিছু সেনাসদস্য কর্তৃক
শিক্ষকদের ওপর হাত তোলার জঘন্য ঘটনার জন্য জনসমক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি ছিল অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ।
৪. নিহতদের পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ: প্রতিটি
নিহত শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি
ওঠে।
৫. ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো প্লেন বাতিল করে আধুনিক প্লেন চালু: দেশের
নিরাপত্তার স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো প্রশিক্ষণ বিমান বাতিল করে আধুনিক ও নিরাপদ বিমান চালু
করার দাবি জানানো হয়।
৬. বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও কেন্দ্র পরিবর্তন:
জনবহুল এলাকার বাইরে নিরাপদ স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থানান্তর এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতিকে আরও মানবিক
ও নিরাপদ করার দাবি ছিল।
আল্লাহর অশেষ রহমতে, আজ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাহেব ঘোষণা করেছেন যে, সরকার শিক্ষার্থীদের এই ছয় দফা দাবি মেনে নিয়েছে। নিহত ও আহতদের তথ্য প্রকাশে একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, দুঃখপ্রকাশ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস, নিহতদের পরিবারকে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ৫ কোটি টাকা ও আহতদের ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা এবং জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান না চালানোর অঙ্গীকার—এগুলো নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এই মহাবিপদে, আমাদের বাংলার জনগণ হিসেবে, আমরা সবাই শোকাহত ও ব্যথিত। মুসলিম হিসেবে আমাদের এখন কিছু বিষয়ে গভীরভাবে মনোনিবেশ করা উচিত, যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নির্দেশিত:
১. ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল: বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের
বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"আর আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরিক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের
ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে। যারা তাদের ওপর বিপদ আসলে বলে, নিশ্চয়
আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।" (সূরা বাকারা:
১৫৫-১৫৬)। আমাদের উচিত এই শোককে ধৈর্যের সাথে গ্রহণ করা এবং আল্লাহর ফয়সালার উপর পূর্ণ বিশ্বাস
রাখা।
২. দোয়া ও ইস্তিগফার: শাহাদাত বরণকারী ও আহতদের জন্য সর্বান্তকরণে দোয়া
করা এবং তাদের মাগফিরাত কামনা করা আমাদের কর্তব্য। আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া করা এবং
নিজেদের পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করা উচিত।
৩. নিহতদের জানাযা ও দাফনে
সহযোগিতা: ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, মৃত মুসলিমদের জানাযা আদায় করা ফরজে কিফায়া। আমরা
সকলে মিলে নিহতদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থায় সহযোগিতা করব এবং তাদের পরিবারের পাশে
দাঁড়াব।
৪. আহতদের পাশে দাঁড়ানো ও সাহায্য: আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে
সাধ্যমতো আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সহায়তা প্রদান করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দুনিয়াবী কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা
কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দূর করে দেবেন।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
২৬৯৯)।
৫. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সতর্কতা: দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে
দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে
বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির উচিত
নিরেপক্ষভাবে ঘটনার তদন্ত করা এবং দোষীদের চিহ্নিত করা। ঝুঁকিপূর্ণ বিমানগুলো বাতিল করে আধুনিক ও
নিরাপদ বিমানের ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতিকে আরও উন্নত করা অপরিহার্য।
৬. সংহতি
ও ভ্রাতৃত্ব: এই কঠিন সময়ে আমাদের সকলের উচিত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা, মুসলিম
ভ্রাতৃত্বের পরিচয় দেওয়া এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা।
কোনো মন্তব্য নেই।